অজ্ঞেয়বাদি রিচার্ড হালভোরসান, হার্ভার্ড ক্রিমজনের সাবেক এডিটরিয়াল এডিটর। মুখ খুলেছেন ডারউইনবাদের আগ্রাসন নিয়ে। ধর্মকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার মহামারি প্রবণতা মুক্তমনা সমাজে প্রশংসিত হলেও, ডারউইনবাদকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা যেন একটা ট্যাবু। নিষিদ্ধ লোবান! ডারউইনবাদের যৌক্তিক সমালোচনা করলেও সেক্যুলার পণ্ডিত বা আম-সেক্যুলার হামলে পড়ে প্রবল ক্রোধে। এই অসুস্থ মানসিকতার সমালোচনা করেন রিচার্ড। হার্ভার্ড ক্রিমজন থেকে প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন – সাইফুল্লাহ বিন ইউসূফ, মোহাম্মাদ আতৃহার আবির ও আহনাফ তাজওয়ার। সম্পাদনা ও ফুটনোট সংযোজন করেছি আমি (রাফান আহমেদ)।

আমাদের আধুনিক সমাজে ধর্মত্যাগতুল্য ও ক্ষমার অযোগ্য কোনো অপরাধ আছে কী?

সব সমাজই নিজেরা কোনো এক আদর্শিক মূর্তি গড়ে নেয়। সমাজের যারা একে মানতে চায় না, তাদের শাস্তি দেয়; একঘরে করে। যে-কোনো সমাজের এমন পবিত্র দেবমূর্তির হদিশ পেতে চাইলে, সে সমাজে যেসব প্রশ্ন নিষিদ্ধ তার খোঁজ করতে হয়। (১) যেমন – মধ্যযুগের ইউরোপে চার্চের সত্যতা প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ সাধারণ্যের ছিল না। কমিউনিস্ট শাসনকালে পার্টির কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করলে সেই কমরেডকে গুলাগ শ্রমিক ক্যাম্পে ছুঁড়ে ফেলা হত। আর এখন, সব নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য হলো সেক্যুলার বিদ্যাপীঠে গিয়ে ডারউইনবাদের মন্ত্র পাঠ করা। বিবর্তন ব্যাখ্যায় নব্য-ডারউইনবাদ কিংবা পাংচুয়েটেড ইকুইলিব্রিয়ার মতো সূক্ষ্ম ব্যাপারস্যাপার শিখতে আমাদের উৎসাহ দেয়া হয় বটে। কিন্তু ডারউইনিয় ধ্যানধারণা যে তাবৎ দুনিয়ার সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে – এই ধারণাকে প্রশ্ন করলেই বুদ্ধিজীবী মহল থেকে আপনাকে সমাজচ্যুত করা হবে।

দেশের জীববিজ্ঞান পাঠ্যবইতে থাকা বিবর্তনের স্বাক্ষ্যগুলোর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ জানতে সহায়ক বই। অর্ডার করতে ছবিতে ক্লিক করুন।

যারা অলীক ধর্মবিশ্বাসের কারণে অন্ধভাবে বৈজ্ঞানিক যুক্তিপ্রমাণ অস্বীকার করে, আমি তাদের পক্ষে সাফাই গাইছি না। একইসাথে যারা ধর্মবিরোধী-বস্তুবাদী মতবাদ দাঁড়া করানোর জন্য বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণকে এড়িয়ে যায়, তাদেরকেও আমার সহ্য হয় না। কিছু বিজ্ঞানীর ধর্মবিরোধী-প্রবণতার কারণে গত শতকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ভালোভাবেই ব্যাহত হয়েছিল। A Brief History of Time এ স্টিফেন হকিং লিখেছেন যে, বিগ ব্যাংয়ের সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও তা কয়েক দশক ধরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল! কারণ এর মাঝে ‘ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত’ পাওয়া যাচ্ছিল। এমনকি, ধর্মের পক্ষে যেতে পারে এই ভয়ে বিগ ব্যাং বলে যে কিছু হয়েছিল সেটাই অস্বীকার করার জোগাড় হচ্ছিল!

যুক্তি দিয়ে আমাদের মৌলিক ধারণাগুলোকে যাচাই করাটা বুদ্ধিবৃত্তিক সততার পূর্বশর্ত। (২) অথচ ডারউইনিজম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা যেন নিজের চিন্তক-সত্তাকে নিজ হাতে গলা টিপে মারার শামিল! যেন পণ্ডিতমহলে এমন সংশয় আসাটা কল্পনার বাইরে, একেবারে অমোচনীয় পাপ যাকে বলে! যদিও উত্তরাধুনিক কালে এসে মানুষ সবকিছুকে প্রশ্নবাণে আঘাত করছে। যেমন – জ্ঞানের অস্তিত্ব, নৈতিকতা; এমনকি এই জগতের অস্তিত্ব আদতেই বাস্তব কি-না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ডারউইনিয় ধ্যানধারণা নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলোচনা একেবারে নিষিদ্ধ। বিবর্তনবিদেরা নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার সাহায্যে ডারউইনের প্রস্তাবনাকে যাচাইয়ের চেষ্টা করেন বটে; কিন্তু সেই হাইপোথিসিসের মৌলিক ভিত্তিগুলোকে এতই পবিত্র ভাবা হয় যে—‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা’! অথচ অন্যসবকিছু নিয়ে আমাদের অনর্থক সংশয়প্রবণতার শেষ নেই। অক্সফোর্ডের প্রাণিবিদ রিচার্ড ডকিন্স তো বলেই বসলেন, “এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, যারা বিবর্তনে বিশ্বাস করে না তারা হয় অজ্ঞ, অথবা বোকার হদ্দ, নয়তো পাগল।”

জীববিজ্ঞানীরা এখনো সেই মরচেপড়া মন্ত্র জপেই যাচ্ছেন, “বিবর্তন তত্ত্ব হলো জীববিজ্ঞানের মৌলিক আর সার্বজনীন মূলনীতি”। একবার ভাবুন তো, যদি আইন্সটাইনকে জোর করে—“নিউটনের তত্ত্ব হলো পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক আর সার্বজনীন মূলনীতি”—এই গীত গাওয়ানো হতো; যদি তিনি আগের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাগুলো দেখেও চোখ বুজে থাকতেন—তাহলে পদার্থবিজ্ঞান আজকে কোথায় পড়ে থাকতো? বিজ্ঞানের নব-উদ্ভাবনগুলো আসে বিদ্যমান প্যারাডাইমের বাইরে থেকে, আর তাই রীতি মেনে চলার প্রবণতা নতুন উদ্ভাবন ব্যাহত করে। যেসব বিজ্ঞানীরা বিবর্তন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন—যেমন Intelligent Design প্রবক্তারা—তারা কিন্তু বিবর্তন একদম অস্বীকার করেন, এমন নয়। তারা বরং বলেন যে বিবর্তন যা যা ব্যাখ্যা করতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার ব্যাপ্তি সীমিত। কিন্তু তেলার্দ দ্যু শার্দ্যাঁ এর মত কট্টর ডারউইনবাদিরা জোর দিয়ে বলেন যে—বিবর্তন হচ্ছে সেই মহান সার্বজনীন স্বীকার্য, যার কাছে অন্য সব থিওরী, হাইপোথিসিস আর সিস্টেম নতি স্বীকার করতে বাধ্য।

কোনটা স্রেফ সংশয় আর কোনটা প্রাতিষ্ঠানিক গোড়ামি, সেটা বুঝতে ডক্টরেট করা লাগে না। এই যেমন ন্যাশনাল সেন্টার ফর সাইন্স এডূকেশনের স্কিপ ইভান্স এর চিন্তা ছিল যে ক্লাসে যদি বিবর্তনের বিপক্ষের যুক্তি-প্রমাণ গুলো আলোচনা করা হয়, তাহলে তা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে “সংশয়ের বীজ” বুনতে পারে। (অধ্যাপকেরাও ডারউইনবাদিদের আগ্রাসন থেকে রেহাই পান না।) তাদের প্রায়ই একঘরে করে ফেলা হয় কিংবা পদাবনতির সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি কখনো কখনো তাদের পদচ্যুত করা হয়। (৪) বেইলর ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপকের গবেষণার জন্য বরাদ্দ তহবিল বাতিল করা হয়েছিল—যখন কর্তৃপক্ষ জানতে পারে তার গবেষণার দ্বারা বিবর্তনের পূর্বানুমানগুলোর ভিত নড়ে যাবে। তাই দেখা যায়, অনেক বিবর্তন নিয়ে সন্দিহান অনেক অধ্যাপক ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। কারণ বিবর্তনের বিপক্ষের যুক্তি-প্রমাণ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু লিখলে তাদের চাকরী চলে যেতে পারে বা ক্যারিয়ারের ক্ষতি হতে পারে। (৫)

বিবর্তন নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করলেই প্রায় সবসময়ই তাকে ‘ধার্মিকদের প্রোপাগান্ডা’ বলে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। দেন। যদিও এখন পর্যন্ত ছাত্রশিক্ষক নির্বিশেষে বিজ্ঞানের কেউই সমালোচকদের যুক্তিগুলোকে সঠিকভাবে সামাল দিতে পারেননি। তারা উত্তর দিতে পারে না প্রাসঙ্গিক যৌক্তিক প্রশ্নগুলোর:

(১) বিবর্তনের সবচেয়ে জোরালো সমালোচনা কোনটি?
(২) সেই সমালোচনার ঠিক কোন অংশটা অযৌক্তিক বা ভুল?

বেশিরভাগ ডারউইভক্ত তো প্রাণরসায়নবিদ মাইকেল বিহি, জিনবিজ্ঞানী মাইকেল ডেন্টন, ভ্রুণতাত্ত্বিক জোনাথন ওয়েলস কিংবা তথ্যবিজ্ঞানী উইলিয়াম ডেম্বস্কিদের মত এর লেখা পড়েইনি। পড়লেও কখনো আমলে নেয়নি। ভিন্নমত পোষণকারী এই মানুষগুলো অচ্ছুত ঘোষণা করে, দ্রোহীর ট্যাগ লাগিয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তাই ভিন্নমতের কন্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়। (৬)

আমাদের সমাজে প্রচলিত এই মিথ্যে উপাস্যগুলোর কাছে মাথা নত করা চলবে না। ডারউইনকে দেবতুল্য বানিয়ে কিংবা বিবর্তনকে সেক্যুলার ধর্মে পরিণত করে বিজ্ঞানের সিকি পয়সার লাভ নেই। কোন তত্ত্বের সমালোচনাগুলোকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে উপেক্ষা করাটাকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সবসময় সেই প্রশ্নটা করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেটা করা সমাজে নিষিদ্ধ।


নোটস:
(১) ইসলামবিদ্বেষীদের প্রতারণায় পরে কারো মনে খটকা লাগতে পারে – ইসলামেও তো প্রশ্ন করা নিষেধ!! এই ভুল ধারণার বিশ্লেষণ জানতে পড়ুন: ইসলাম কি প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করে?
(২) কুরআন আমাদের চিন্তা করতে উৎসাহ দেয়ে বারবার, যাচাই করে মেনে নিতে বলে। ইসলামের যৌক্তিক এই অবস্থান সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলমানই জ্ঞাত নন। কারন তাদের অধিকাংশই দ্বীনের বদলে দুনিয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে জীবন যাপন করেন। ইসলাম নিয়ে পরা, জানা, আলোচনা করা, প্রচার করা এগুলো কোনোটাই তারা করেন না। ফলে ইসলা শুধু থেকে যার এক সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে। ইসলামে যৌক্তিক ও প্রমাণিক আস্থার জন্য The Divine Reality, The Eternal Challenge, The Forbidden Prophesies ইত্যাদি বই প্রাথমিক ভাবনার খোরাক হিসেবে চমৎকার।
(৪) এ বিষয়ে প্রামাণ্যচিত্র দেখুন: Expelled: No Intelligence Allowed
(৫) এর সত্যতা জানার জন্য পড়তে পারেন অজ্ঞেয়বাদি সাংবাদিক রিচার্ড মিলটনের বই Shattering the myths of Darwinism