নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্স স্বপ্নাতুর চোখে তাকিয়ে আছেন নাস্তিকতার মুলমন্ত্রের দিকে। মনচাহি জিন্দেগি তাদের পরম চাওয়া।

নাস্তিকতা হলো হাল আমলের ফ্যাশন, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। তারুণ্যের মনচাহি জিন্দেগীর সামনে বাধার মতো দাঁড়িয়ে থাকে ধর্ম, তাই ধর্ম ছেড়ে দিলে খালি মজা আর মজা (যদিও নাস্তিকদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি)। ফলে দেখা যায়, এদের নাস্তিকতার প্রায় শতভাগই হলো ইসলাম নিয়ে হাসিঠাট্টা আর নিজেদের দর্শনের বেসিক সম্পর্কে মহা-অজ্ঞতা। তাই অনেককে বুক ফুলিয়ে কুযুক্তি খাটাতে দেখা যায়:

নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে ‘বাগান না করাও একটি শখ, ক্রিড়া না খেলাও একটি ক্রীড়া, কোকেইন সেবন না করাও একটি নেশা।’

জুবায়ের অর্নব

বিষয়টি খোলাসা করার আগে চলুন নাস্তিকতা কি তা নিয়ে একটু আলাপচারিতা করা যাক। ইংরেজি Atheist (এথিইস্ট) শব্দটি মূলত গ্রীক থেকে আসা। দুটি গ্রীক শব্দ (a+theos) মিলে গিয়ে এর অর্থ দাঁড়িয়েছে – “এক বা একাধিক স্রষ্টার অস্তিত্বে যে অবিশ্বাসী”। (১) তবে এথিইস্ট শব্দের শুরুটা কিন্তু এই অর্থে হয় নি। ইতিহাস থেকে জানা যায় খ্রিস্ট পরবর্তী দ্বিতীয় শতকে খ্রিস্টানরা মুখ বেজার করে অভিযোগ করতো – দেখো! ওরা আমাদের এথিইস্ট বলছে, অথচ এই অভিযোগ ওদের ঘাড়েই বর্তায়! তো ওরা, মানে রোমান পৌত্তলিকেরা খ্রিস্টানদের ‘এথিইস্ট’ বলে অভিহিত করত কেন? কারণ খ্রিস্টানরা রোমান পৌত্তলিকদের প্রচলিত ধর্মকর্মে বিশ্বাসী ছিলো না, তাই। (২) গবেষকদের মতে সেই প্রাচীন যুগে আজকের প্রচলিত অর্থে নাস্তিক কারো হদিশ মেলা ভার। প্রচলিত ধর্মাচারের বিরোধীদের গায়েই নাস্তিক তকমা লাগানো হতো। (৩)

অন্যদিকে বাংলাতে Atheist এর প্রতিশব্দ হলো ‘নাস্তিক’। এই শব্দের বুৎপত্তিতেও কিন্তু মজার ব্যাপার আছে। উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর ‘ভারত দর্শনসার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “বেদে অবিশ্বাসীরাই নাস্তিক বলে আখ্যায়িত। চার্বাক এই অর্থে নাস্তিক” (৪) বোঝা যাচ্ছে এক্ষত্রে চার্বাকের দোষ ছিলো দ্বিতীয় শতকের খ্রিস্টানদের মতই। খ্রিস্টানরা রোমান পৌত্তকদের আচার-বিশ্বাস মানে নি, আর চার্বাক মহাশয় বেদের বিধিবিধান মানে নি। একই কাতারে শামিল হয় বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম। ভাষা ও শব্দ যেহেতু বিবর্তনশীল তাই সময়ের স্রোতে নাস্তিক অর্থ স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাস – এসে থিতু হয়েছে। কিন্তু ঝামেলা হলো, বিদ্যানগণ নাস্তিক্যবাদের কোন সংজ্ঞতেই এখন পর্যন্ত একমত হতে পারেন নি।

ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দেখা যায় নাস্তিকদের অধিকাংশ জীবনদর্শন হিসেবে অস্তিত্বগত প্রকৃতিবাদ বা বস্তুবাদকে (Philosophical/ontological/metaphysical Naturalism) গ্রহণ করেন। বস্তুবাদ বলতে চায় সুবিশাল এই মহাবিশ্বে ঘটে চলা সকল ঘটনাই জাগতিক বা ভৌত প্রক্রিয়ার হয়। এই ভৌত প্রক্রিয়াগুলো উদ্দেশ্যহীন, এলোমেলো, অযৌক্তিক স্রেফ জড় প্রক্রিয়া। বস্তুজগতের বাইরে কোনো অতিপ্রাকৃত কিছু থাকতে পারে না। নব্য নাস্তিক্যবাদের অন্যতম পুরোধা রিচার্ড ডকিন্স নাস্তিকদের এই বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন,

“দার্শনিক বস্তবাদি অর্থে নাস্তিক হলো এমন ব্যক্তি যে বিশ্বাস করে পার্থিব, ভৌত জগতের বাইরে কিছু নেই। কোনো স্রষ্টা নেই যিনি দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বের পিছনে চুপিসারে কলকাটি নাড়ছেন। আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই যা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে, নেই অলৌকিক বলে কোনো কিছু। কেবলই রয়েছে জাগতিক ঘটনাবলী, যা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারি নি।”

Richard Dawkis, The God Delusion; p. 14 (London: Bantham Press 2006)

সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ তাঁর আমার অবিশ্বাস গ্রন্থে লিখেন,

“… আমি কোনো মহাপরিকল্পনা নই, কোনো মহাপরিকল্পনার অংশ নই, আমাকে কেউ তার মহাপরিকল্পনা অনুসারে সৃষ্টি করে নি; একরাশ প্রাকৃতিক ক্রিয়ার ফলে আমি জন্মেছি, অন্য একরাশ প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে আমি ম’রে যাবো, থাকবো না; যেমন কেউ থাকবে না, কিছু থাকবে না।…”

হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস; পৃ. ১৩ (ঢাকা, আগামী প্রকাশনী, সপ্তম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারী ২০১১)

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, নাস্তিকেরা মেটাফিজিক্যাল প্রকৃতিবাদকে ওয়ার্ল্ডভিউ মনে করে। মজার ব্যাপার হলো, এই দার্শনিক বস্তুবাদও কিন্তু স্রেফ বিশ্বাসগত অবস্থান! সেজন্য দেখা যায়, একাডেমিক বইপত্রে নাস্তিকতাকে মেটাফিজিকাল প্রকৃতিবাদ বলা হয়। কি, অবাক হলেন! এটা আমার কথা না কিন্তু, নাস্তিক গবেষকের কথা যিনি ডকিন্স গংদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সৎ। সুপরিচিত নাস্তিক বিজ্ঞান-দার্শনিক প্রফেসর মাইকেল রুজ বলেন,

“আপনি যদি স্বীকারোক্তি চান তবে শুনুন, আমি সবসময় স্বীকার করেছি বস্তুবাদ হলো স্রেফ অন্ধবিশ্বাস… ”

Stewart, R. B. (ed.). (2007) Intelligent Design: William A. Dembski & Michael Ruse in Dialogue. Minneapolis, MN: Fortress Press, p.37

নাস্তিকদের পূজ্য সেলিব্রেটি নাস্তিক কার্ল স্যাগানও এহেন বিশ্বাসকে অন্ধবিশ্বাসই বলেছেন! আমি হলফ করে বলতে পারি, এমন স্বীকারোক্তি আপনি বঙ্গীয় মুক্তমণাদের লেখাজোকায় পাবেন না। আপনি দেখতে পাবেন এরা পাতার পর পাতা লিখে বুক ফুলিয়ে তা অস্বীকার করে চলছে। (৫)

মিডিয়া ফিগার, নাস্তিক ও ফেমিনিস্ট লেখিকা ইজিওমা ওলু’র কলমে এই স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়,

“… স্রষ্টা নেই আমার এহেন দৃঢ় বিশ্বাস কেবলই অন্ধবিশ্বাস। আমরা যেমন (বস্তুগতভাবে) প্রমাণ করতে পারবো না যে স্রষ্টা আছেন, একইভাবে এও প্রমাণ করতে পারবো না যে স্রষ্টা নেই। স্রষ্টা না থাকার অনুভূতির স্বীয় সত্তার মাঝে পুরেই আমি দিনানিপাত করি। কিন্তু আমি মোটেও এই ঘোরের মধ্যে থাকি না যে, আমার এই অনুভূতি আস্তিকদের স্রষ্টার অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাসের তুলনায় বেশি তথ্যপ্রমাণ নির্ভর।”

Ijeoma Oluo, My atheism does not make me superior to believers. It’s a leap of faith too. The Guardian, 24 Oct 2015

নাস্তিকতা হলো স্রেফ বিশ্বাসগত অবস্থান, তারা সুকৌশলে বিজ্ঞানের চাদর জড়িয়ে বস্তুবাদের বিশ্বাসকে লুকিয়ে রাখে। বঙ্গীয় নাস্তিকেরা তো এসব জানেই না। কারণ, ঐ যে বললাম, এরা তো জেনে নাস্তিক হয় নি, হুজুগে হয়েছে। এছাড়া যারা বলতে চায় নাস্তিকতা ধর্ম না, তাদের চিন্তাতেও সংকির্ণতা আছে। নাস্তিক্যবাদ সেই বিষয়গুলোরই উত্তর দিতে চায় যেগুলো ধর্ম দেয় – মেটাফিজিক্স, নৈতিকতা, জীবনাচার ইত্যাদি। তাই নাস্তিকতাকে ধর্ম না বলাও যৌক্তিক বিচারে অপরিপক্ব চিন্তা

Reference:
(১) জুলিয়ান বাগিনি, এথিইজম: এ ভেরি শর্ট ইনট্রোডাকশন; পৃ. ০৩ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৩)। অক্সফোর্ড অনলাইন ডিকশনারিতে উপরের সংজ্ঞার সাথে “বা যার বিশ্বাসে ঘাটতি রয়েছে” অংশটুকুও যুক্ত করা হয়েছে। যদিও অন্যান্য প্রথম সারির ইংরেজি অভিধানগুলোতে এই বাড়তি অংশটি পাওয়া যায় না।
(২) স্টিফেন বুলিভ্যান্ট, মাইকেল রুজ (সম্পাদিত), দি অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অফ এথিইজম; পৃ. ১৫৪-১৫৫ (অক্সফোর্ড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৩)
(৩) প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫২
(৪) উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. আর এম দেবনাথ রচিত সিন্ধু থেকে হিন্দু গ্রন্থে উদ্ধৃত; পৃ. ২০৯
(৫) অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর, অবিশ্বাসের দর্শন; পৃ. ২৬৫-২৬৭ (ঢাকা, শুদ্ধস্বর প্রকাশন, ২য় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারী ২০১২)

© 2019. No part of this article can be published in print form without prior approval from author.